ঢাকা, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা : পড়ার টেবিলে ফেরানো যাচ্ছে না শিক্ষার্থীদের

২০২৫ এপ্রিল ২৫ ১৮:৩৮:৩৬
শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা : পড়ার টেবিলে ফেরানো যাচ্ছে না শিক্ষার্থীদের

ডুয়া প্রতিবেদক: গত ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে থাকেন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাঠামো। গত আট মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ নানা দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মারামারি, শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীরা বই হাতে না পাওয়াসহ নানান ঘটনায় শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা চলতে থাকে। শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফেরানোই যেন বড় চ্যালেঞ্জ।

সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এর বড় উদাহরণ। শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে গেল কয়েকদিন ধরে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন, অনশন ছাড়াও ক্লাসও বর্জন করতে দেখা যায়। সর্বশেষ বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া এবং উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তা মোটামুটি সমাধানের পথে আসলেও তার রেশ এখনো কাটেনি। অন্যদিকে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে পলিটেকনিকে। ৬ দফা দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন না। সরকারের আশ্বাসেও তা থামেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন করার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করলেও পরে সদস্য পরিবর্তন করে ফের আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।

গত বছরের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নামেন। কয়েক মাস চলে এই আন্দোলন। সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। পরে অধিভুক্ত বাতিল এবং আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে এখনো তা চূড়ান্ত না হওয়ায় সেখানেও অস্থিরতা চলছে। অন্যদিকে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। সেসময় যাত্রীবাহী ট্রেনে ঢিল ছুড়ে আহত করেন শিশুসহ অনেক যাত্রীকে।

এ ছাড়া ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হয় সংঘর্ষ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) আজিজ হল ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসব ঘটনায় বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবারও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার তাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এ সংঘর্ষের কারণে মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে আশপাশের সড়কে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। ফলে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।

কদিন আগেই, গত ১৫ এপ্রিল একই এলাকায় এ দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। বস্তুত এ দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো যেন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই ছোটখাটো ঘটনায় তারা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। শুধু এ দুই কলেজ নয়, প্রকৃতপক্ষে অতীতে বিভিন্ন সময় এ এলাকায় অবস্থিত তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। এই তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো-ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ এবং আইডিয়াল কলেজ। ডিএমপির সূত্রমতে, এ তিন কলেজেন শিক্ষার্থীরা ছয় মাসে মারামারি-সংঘর্ষে জড়িয়েছেন প্রায় ১২০ বার। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে এই দুই কলেজসহ ধানমন্ডি এলাকার আরও তিনটি কলেজ মিলে একটি সমঝোতা চুক্তি হবে। সেই সমঝোতা চুক্তি অনুসরণ করলে এই ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ হবে না বলে মনে করছেন তারা। এ ছাড়া সময়মতো বই দিতে না পারায় গত কয়েক মাসে সঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষকসংকট প্রকট। এতে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎসব করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়ার বিষয়টি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কারণে এই বছর প্রথম দিনে সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোয় নতুন বই বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে বই পায়নি। গত চার মাসেও এখনো সব শিক্ষার্থী বই পায়নি।

শুধু শিক্ষার্থীরা নয় শিক্ষকদের আন্দোলনেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। গত সাত মাসে শ্রেণিকক্ষের চেয়ে আন্দোলনের মাঠেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষকরা। রাজধানীতে এমন কোনো শিক্ষক সংগঠন নেই, তারা তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেনি। একাধিক শিক্ষক সংগঠন রাজধানীতে অবস্থান কর্মসূচি, অনশন, কর্মবিরতি, বিক্ষোভ-ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি পালন করেছে। অনেক সময় শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর জন্য জলকামান, লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার করতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে।

বর্তমানে ছোটখাটো দাবিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের আন্দোলন করছেন। এমনকি যা আলোচনার টেবিলে সমাধান সম্ভব, সেগুলো নিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাইরে বিক্ষোভ করছেন, ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ করছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।

সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা যেন আর না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। পুরো সমাজ একটি অস্থিরতার মধ্যে চলছে এবং সব যে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে, সেটা ভাবাও বোধ হয় ঠিক নয়।’

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশৃঙ্খলা ও দাবি দাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত সময়ে ছাত্ররা যখনই কোনো দাবি উপস্থাপন করতেন, তখনই রাষ্ট্র ঝাপিয়ে পড়ত তাদের ওপর। এখন যেহেতু আগের পরিস্থিতি নেই, তাই সবাই একসঙ্গে তাড়াহুড়ো করে হয়তো দাবিগুলো তুলতে গিয়ে দেশে এমন পরিস্থিতি হচ্ছে। যা যথেষ্ট উদ্বিগ্নের বিষয়। তিনি আরও বলেন, আমরা ছাত্রদের আশ্বস্ত করছি যে তাদের দাবিগুলো সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখে নিয়ম ও আইনের মধ্যে থেকে উপযুক্ত সমাধানের চেষ্টা করবে সরকার।

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শিক্ষা এর সর্বশেষ খবর

শিক্ষা - এর সব খবর



রে