ঢাকা, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

বেরিয়ে এলো নতুন আয়নাঘর, অনুসন্ধানে মিললো ভয়াবহ চিত্র

২০২৫ এপ্রিল ১৭ ১০:৪৬:২৫
বেরিয়ে এলো নতুন আয়নাঘর, অনুসন্ধানে মিললো ভয়াবহ চিত্র

ডুয়া ডেস্ক: ভিন্নমত সহ্য করতেন না ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা—এটা বহু আগে থেকেই জানা। সাবেক বন্দি, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তদন্তকারীরা জানিয়েছেন সরকারবিরোধী কথা বললে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল সবসময়।

অনেকেই গোপনে আটকে রাখা হতো ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাত গোপন বন্দিশালায়। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এমন বহু গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশজুড়ে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে এসব গোপন নির্যাতনকেন্দ্রের চিত্র। তখন মুক্তি পান শত শত বন্দি।

বুধবার (১৬ এপ্রিল) বিবিসির এক প্রতিবেদন জানায়, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে একটি নতুন ‘আয়নাঘর’-এর সন্ধান মিলেছে। এই গোপন কেন্দ্রেই আট বছর ধরে বন্দি রেখে নির্যাতন করা হয় ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে। তার চোখ বেঁধে রাখা হলেও কাছের বিমানবন্দরের অবতরণ শব্দ শুনে তিনি জায়গাটির অবস্থান আন্দাজ করতে পারেন। তার তথ্যের ভিত্তিতেই তদন্তকারীরা নতুন এই আয়নাঘরটির খোঁজ পান।

আয়নাঘরের সন্ধানে তদন্তকারীরা যখন একটি বড় ভবনের পেছনে একটি নবনির্মিত দেয়াল দেখেন তখন তাদের সন্দেহ হয়। দেয়ালটি ভাঙার পর তারা একটি সরু করিডোর আবিষ্কার করেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল সেই করিডরে। একটু সামনে এগিয়ে তারা দেখলেন করিডরের বাইরে ডানে ও বামে ছোট ছোট জানালাবিহীন বেশ কয়েকটি কক্ষ। সেখানের একটিতে আটকে রাখা হয় ব্যারিস্টার কাসেমকে।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বোঝাই যাচ্ছিল ইটের তৈরি নতুন দেয়াল ছিল এই আয়নাঘরকে দৃষ্টির আড়ালে রাখার অপচেষ্টা। এমনভাবেই ঘরগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল যে, সেখানে দীর্ঘবছর অন্তরীণ থাকা মীর আহমদ বিন কাসেমের স্মৃতির সহযোগিতা না নিলে হয়ত তারা কখনও এই গোপন কারাগার খুঁজে পেতেন না।

তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রাস্তার ওপারে খুঁজে পাওয়া গোপন কারাগারটি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কিছু সদস্যদের দিয়ে পরিচালিত হত, যারা সরাসরি হাসিনার নির্দেশে কাজ করছিলেন।

ব্যারিস্টার কাসেম ধীরে ধীরে কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে একটি ভারি ধাতব দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেন। একটু মাথা নিচু করে আরেকটি সরু দরজা দিয়ে একটা কুঠুরিতে প্রবেশ করেন।

বিন কাসেম জানিয়েছিলেন, তাকে যে সেলে রাখা হয় তার টাইলসগুলো ছিল হালকা নীল। তার কথার সূত্র ধরেই তদন্তকারীরা ওই সেলে গিয়ে দেখেন, মেঝেতে টুকরো টুকরো নীল টাইলস পড়ে আছে। নিচতলার সেলগুলোর তুলনায় ওই সেলটি অনেক বড়, ১০ ফুট বাই ১৪ ফুট। এর একপাশে একটি বসার টয়লেট রয়েছে।

মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নীল টাইলসগুলো অনুসরণ করে কাসেম তদন্তকারীদের নিয়ে যান যেখানে, তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। টর্চের আলোয় দেখা গেলে, কাসেমকে রাখা হয়েছিল যেই কক্ষটিতে সেটা এত ছোট যে, একজন সাধারণ মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হবে। আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল সেখান থেকে। তদন্তকারীরা কিছু দেয়াল ভাঙা এবং ইট ও কংক্রিটের টুকরো মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। তারা জানান, অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করার শেষ চেষ্টা হয়েছিল আয়নাঘরটিতে।

৪০ বছর বয়সি এই আইনজীবী প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সামনে আয়নাঘরে তার বন্দিদশার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলেন।

তিনি তদন্তকারীদের জানান, এই কক্ষেই তাকে আট বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। ঘরটিতে ছিল না কোনো জানালা বা এমন কোনো ছিদ্র ছিল না যা দিয়ে দিনের আলো প্রবেশ করতে পারে। আলো দেখতে না পারায় কাসেম দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতেন না তিনি।

বিবিসিকে আহমদ বিন কাসেম বলেন, ‘এভাবেই আটটা বছর বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। মনে হচ্ছিল জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল আমাকে। গ্রীষ্মকালে অসহ্য গরম ছিল। মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম এবং যতটা সম্ভব দরজার নিচে মুখ রাখতাম, যাতে কিছুটা বাতাস পাওয়া যায়।’

তদন্তকারীদের সন্দেহ, কাসেমকে রাখা প্রথম স্থানটি ছিল ঢাকার গোয়েন্দা শাখার কোনো ভবনে।

ব্যারিস্টার কাসেম অভিযোগ করেন, ‘উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যারা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাকে সহায়তা করেছিলেন ও মদদ দিয়েছিলেন, তারা এখনও স্বপদে-অবস্থানে বহাল রয়েছেন।’

তাকে কেন গুম করা হয়েছিল প্রশ্নে তার বিশ্বাস, পারিবারিক রাজনীতির কারণে তাকে গুম করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তিনি তার বাবা মীর কাসেমের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, যিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র সদস্য ছিলেন, যাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

ব্যারিস্টার কাসেমসহ গুমের শিকার আরও পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন তদন্তকারীরা। তারা জানিয়েছেন, সৌভাগ্যগুণে তারা পরিবার-স্বজনদের কাছে ফিরতে পারলেও অনেক বন্দিকে চিরতরে গুম করে ফেলেছে হাসিনা সরকার, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।

আয়নাঘর থেকে মুক্তির পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও বিন কাসেমসহ অন্যান্য ভুক্তভোগীদের এখনও তাদের অপহরণকারীদের ভয়ে দিন কাটছে, কখন না যেন ফের গুমের শিকার হন।

ব্যারিস্টার কাসেম বলেন, ‘আমি কখনও টুপি ও মাস্ক না পরে বাড়ি থেকে বের হই না। কোথাও বের হলে সবসময় পেছনের দিতে তাকাই আমি।’

কংক্রিটের তৈরি যে কক্ষে মীর আহমদ বিন কাসেম বন্দি ছিলেন, সেটার অবশিষ্টাংশের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর অবশ্যই বিচার হতে হবে, যাতে দেশ এ অধ্যায়টি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে।’

বিন কাসেম ছাড়াও আয়নাঘর থেকে বেঁচে ফেরা আরও পাঁচ ব্যক্তি বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে অন্ধকার কংক্রিটের কক্ষে রাখা হয়েছিল। যেখানে বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানার উপায় ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছিল।

তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারলেও তারা এখনও ভয় পাচ্ছেন যে, কখন যেন রাস্তায় বা বাসে তাদেরকে অপহরণ করা ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়!

এমনই একজন ভুক্তভোগী আতিকুর রহমান রাসেল। ৩৫ বছর বয়সি এ যুবক বিবিসিকে বলেন, ‘এখন বাসে উঠলে বা বাড়িতে একা থাকাকালে আমি কোথায় ছিলাম তা ভেবে ভয় পাই। কীভাবে আমি বেঁচে গেলাম, আমার কি আসলেই বেঁচে থাকার কথা ছিল! - বার বার এই ভাবনা আসে মাথায়।’

তিনি বলেন, তারা নির্যাতন করে আমার নাক ভেঙে দিয়েছে। হাতকড়া পরিয়ে রাখার কারণে আমার হাত এখনো ব্যথা করছে।

রাসেল বলেন, গত জুলাই মাসে যখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে, তখন পুরান ঢাকার একটি মসজিদের বাইরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয়ে সাদা পোশাকে একদল লোক আমার পথ রোধ করে। মুহূর্তেই আমাকে একটি ধূসর রঙের গাড়িতে তুলে নেন তারা। হাতকড়া পরায়, চোখ বেঁধে টুপি পরিয়ে মুখ ঢেকে দেয়। ৪০ মিনিট ধরে গাড়িটি চলে। এরপর আমাকে টেনে বের করে একটি ভবনে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে রাখে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর লোকেরা একে একে আসতে শুরু করেন এবং নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। জবাব দিলেও মারধর করতে থাকেন তারা।

তাকে কেন আটক করা হয়েছিল প্রশ্নে রাসেল বলেন, ‘আমাকে আটকের কারণ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ আমি বিএনপির একজন ছাত্রনেতা ছিলাম, আমার বাবাও বিএনপির একজন সিনিয়র সদস্য ছিলেন। আমার ভাই দেশের বাইরে থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতেন।’

রাসেলের মতো আয়নাঘরে আটক ও নির্যাতনে শিকার ইকবাল চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ আনা হয় এবং তিনি বলেন, এ কারণেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।

৭১ বছর বয়সি এ বৃদ্ধ বলেন, ‘আমাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, মারধর করা হয়েছে। ইলেকট্রিক শকের কারণে এখন আমার একটি আঙুল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমার পায়ের জোর কমে গেছে, শরীরের জোরও কমে গেছে।’

ইকবাল জানান, অন্য মানুষদের শারীরিক নির্যাতন, মানুষের চিৎকার এবং যন্ত্রণায় কান্নার শব্দ পাওয়ার কথা তার মনে পড়ে। তিনি বলেন, সেই ভয়ানক দিনগুলো কথা মনে পড়লে আমি এখনো আতঙ্ক বোধ করি।

২৩ বছরের রহমতুল্লাহও একই আতঙ্কে ভুগছেন। তিনি বলেন, ‘তারা আমার জীবন থেকে দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। ওই সময়টা আর কখনোই ফিরে পাব না।’

২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট মধ্যরাতে নিজের বাড়ি থেকে রহমতুল্লাহকে উঠিয়ে নেয় র‍্যাব কর্মকর্তারা। ওই সময় র‍্যাব কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ইউনিফর্ম পরা ছিলেন। আবার কেউ কেউ সাদা পোশাকে ছিলেন। তখন পাশের একটি শহরে রান্নার কাজ করতেন রহমতুল্লাহ। সেই সঙ্গে তিনি ইলেকট্রিশিয়ান হতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।

বারবার জিজ্ঞাসাবাদের পর রহমতুল্লাহর কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতবিরোধী এবং ইসলামি পোস্ট করার জেরেই তাকে জোরপূর্বক তুলে নেওয়া হয়েছে। তাকে যেই কক্ষে (সেল) আটক রাখা হয়েছিল, কাগজে-কলমে ব্যবহার করে তিনি সেটার ছবি আঁকেন। ওই কক্ষে একটি খোলা ড্রেন ছিল। সেখানেই তাকে মল–মূত্র ত্যাগ করতে হতো।

বিবিসির পক্ষ থেকে আরও সাবেক দুই বন্দির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তারা হলেন-মাইকেল চাকমা ও মাসরুর আনোয়ার। তাদের দেওয়া তথ্যে গোপন বন্দিশালা এবং সেগুলোর ভেতরে তাদের সঙ্গে আসলে কী ঘটেছিল, সেসব নিয়ে ধারণা লাভের চেষ্টা করা হয়েছে।

আওয়ামী শাসনামলে আয়নাঘরে কতজন নির্যাতনের শিকার - তার সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। ২০০৯ সাল থেকে গুমের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে আসছে একটি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা। কমপক্ষে ৭০৯ জনকে গুম করার তথ্য নথিভুক্ত করেছে সংস্থাটি। তাদের মধ্যে ১৫৫ জন এখনো নিখোঁজ। গত সেপ্টেম্বরে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠনের পর থেকে তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৬৭৬টিরও বেশি অভিযোগ পেয়েছেন। আরও মানুষ অভিযোগ নিয়ে আসছেন।

তথ্য : বিবিসি

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন
ট্যাগ: আয়নাঘর

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে