ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

প্রলয় গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতিত সেই শিক্ষার্থী এখন তাদেরই পাল্টা মামলার আসামী

২০২৫ মার্চ ১৩ ১৮:৫৭:২৭
প্রলয় গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতিত সেই শিক্ষার্থী এখন তাদেরই পাল্টা মামলার আসামী

ঢাবি প্রতিনিধি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত প্রলয় গ্যাং সদস্যের হাতে নির্যাতনের শিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলভী আরসালান এখন উল্টো সেই গ্যাং সদস্যদের করা মামলায় আসামী। শুধু এই ছাত্রকে নয়, ছাত্রের মা এবং ছাত্রের সাথে থাকা বান্ধবীকেও আসামী করা হয়েছে। বর্তমানে এই শিক্ষার্থীর মা কারাগারে আছেন আর এই শিক্ষার্থী এবং তার বান্ধবী আছেন গ্রেফতার আতঙ্কে।

২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে তৈরি কথিত প্রলয় গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীর আলভী আরসালান। সেই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তোভোগী এই শিক্ষার্থীর মা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসালটেন্ট ডা. রেহানা আক্তার। পরে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে আসামীদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ কয়েকজন অভিযুক্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।

গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব সেই ঘটনায় উল্টো ডা. রেহেনা, তার সন্তান আলভী এবং সেদিন আলভীর সাথে থাকা এক বান্ধবীর নামে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী জুবায়ের ইবনে হুমায়ুন এবং তাহমিদ ইকবাল মিরাজ। এই তিনজনই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মায়ের করা মামলায় আসামী।

এই ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আলভী আরসালন এবং তার পিতা অধ্যাপক ডা. মীর মোশাররফ হোসেন। তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান।

সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী ও যুগ্ম সদস্যসচিব মাহবুবুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রলয় গ্যাং সদস্যদের সেই মামলায় ডা. রেহেনাকে গ্রেফতার করে কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকটা মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। একমাসেরও বেশি সময় ধরে ডা. রেহেনা কারাগারে আছেন। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচার চান।

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীর পিতা ডা. মীর মোশাররফ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আমার দুই ছেলে সম্মুখযোদ্ধা ছিলো। ছোট ছেলে পুলিশের ছররা গুলিতে আহতও হয়েছে। আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছি।

গত ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার ছেলে তার এক বান্ধবীকে নিয়ে বসে থাকার অপরাধে ছাত্রলীগের কথিত প্রলয় গ্যাং সদস্যদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। এই ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে মামলা করলে কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত বছরের অক্টোবরে হঠাৎ করে আমাদেরকে অবগত করানো ছাড়া এই মামলার আসামীরা জামিন পেয়ে যায়। এরপর আমরা আপিল করি। এই আপিল করার অপরাধে আসামীরা আমার স্ত্রী, সন্তান এবং তার বান্ধবীর নামে মামলা দেয়। অথচ সেদিন তারা ছিলো ৯-১০জন আর বিপরীতে ছিলো শুধু আমার ছেলে ও তার বান্ধবী। তারাই আমার ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে আর এখন তাদের মামলায় আমাদের আসামী করা হয়েছে। আর পুলিশও কোনরকম তদন্ত ছাড়া এই মামলা গ্রহণ করেছে।

তিনি বলেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারি চেম্বার থেকে আমার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। আর আমার ছেলে এবং তার বান্ধবিকে খুঁজতে বাসায় যায় পুলিশ। এখন তারা গ্রেফতার আতঙ্কে বাসায়ও থাকতে পারছে না।

ডা. মীর মোশাররফ বলেন, এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আমার স্ত্রীকে কোর্টে তোলা হলে আদালাত আমার স্ত্রীকে জামিন দেয় কিন্তু সাথে সাথে পুলিশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ আগস্ট গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় করা মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে গ্রেফতার দেখায়। এর কয়েকদিন পর বংশাল থানায় করা ৫ আগস্টের আরেকটি হত্যা মামলায়ও অজ্ঞাতনামা হিসেবে আমার স্ত্রীকে গ্রেফতার দেখায়। অথচ গত ২৮ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত আমার স্ত্রী হাসপাতালের সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে বাসায় বেডরেস্টে ছিলো। যেটির সত্যতা নিশ্চিত করে বিএসএমএমইউ কতৃপক্ষ আমার স্ত্রীর অর্জিত ছুটি মঞ্জুর করেছে। এছাড়া, ৪ আগস্ট গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে যেখানে কমিটি এই ঘটনায় ১৪৪ ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। সেই তালিকায়ও আমার স্ত্রীর নাম নেই।

ডা. মীর মোশাররফ বলেন, আমার স্ত্রী ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য উপকমিটির সদস্য হওয়ার অপরাধে এই মিথ্যা মামালাগুলো দিয়েছে। আমার স্ত্রী বর্তমান কোন উপকমিটির সদস্যও না। এই আন্দোলনের পুরোটা সময় সে আওয়ামীলীগের কোন সভা সমাবেশে পর্যন্ত অংশ নেয়নি। বরং আন্দোলন চলাকালীন সন্তানদের গ্রাফিতি আঁকাসহ বিভিন্ন কাজে অর্থ সহায়তা দিয়েছে, কখনো আন্দোলনে যেতে বাধা দেয়নি। যেই কথাটা সন্তানরা ৩ আগস্ট যমুনা টিভির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেও। এছাড়া, সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে আন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াতে।

ডা. মীর মোশাররফ বলেন, জুলাই আন্দোলনই মানুষকে মাপার একমাত্র টেস্ট। সেই আন্দোলনে আমাদের পরিবার অংশগ্রহণ করেও আজ মিথ্যা মামলায় আমার স্ত্রীকে জেল খাটতে হচ্ছে আর সন্তানকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই হতাশার বিষয়।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আলভী আরসালান বলেন, বইয়ে পড়েছি, ১৯৭১ সালে মায়েরা নাকি ছেলেদের মাথায় পতাকা বেঁধে যুদ্ধে পাঠাতো। সেটি আমি অনুভব করেছে এই জুলাই অভ্যুত্থানে। আমার আম্মুর পা ভাঙা থাকায় নিজে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করতে পারলেও নিজের দুই ছেলেকে মাঠে নামিয়েছে।

আলভী বলেন, এখন আমার মা জেলে, আমরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়। আমাদের আন্দোলন ছিল ন্যায়বিচারের জন্য। অথচ এখন আমরাই অন্যায়ের শিকার হচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব ওমর ফারুক বলেন, জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ওনারা ছিলেন না। উনি, ওনার স্বামী ও ছেলেকে এই আন্দোলনে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধাকে এবং তার মাকে যদি এভাবে হয়রানি মামলা দেওয়া হয় তাহলে এটা কোন ষড়যন্ত্র কিনা সেটি খতিয়ে দেখা উচিত।

এই নেতা বলেন, ডা. রেহেনা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। যেহেতু উনি জরায়ু ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং টেস্টটিউব বেবি নিয়ে কাজ করেছেন সেহেতু উনার সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে সবার ছবি থাকতে পারে। পুলিশকে বলবো, আপনারা মামলা দিবেন পর্যাপ্ত তদন্ত এবং প্রমাণ সংগ্রহ করে। ছবি থাকলেই মামলা এটা ত ফ্যাসিস্ট আমলে চরিত্র। উনি অপরাধী কিনা সেই বিবেচনায় মামলার বিষয়টি নির্ধারণ হওয়া উচিত।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মায়ের করা মামলার আসামী এবং পাল্টা মামলার বাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব অভিযোগের বিষয়ে বলেন, এই অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের করা মামলাটাই সত্য। ডা. রেহেনা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। সেসময় পুলিশ আমাদের কোন কথা শুনেনি। তাই আমরা এখন মামলা করেছি।

ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে নাজমুস সাকিব বলেন, হলে থাকতে হলে সবাইকেই ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত থাকতে হয়েছে। সেভাবেই আমরা ছিলাম।

মামলার বিষয়ে জানতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মনসুরকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, আপনি যাদের ব্যাপার ফোন দিয়েছেন সেই মা ও ছেলে ফ্যাসিস্টের দোসর। এসময় তিনি এই প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে ডা. রেহেনার সাথে আওয়ামীলীগের কয়েকজন এমপি মন্ত্রীর গ্রুপ ছবি পাঠান এবং ছেলে আলভীর একটি স্ক্রিনশট পাঠান যেখানে দেখা যাচ্ছে আলভী একজন মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা দিচ্ছেন। এ কয়েকটি ছবি ২০২৪ সালের শুরুর দিকের এবং আগের বছরের।

এসব ছবি ত কোন অপরাধের প্রমাণ না, যেসব মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সেসব মামলার কোন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেসবও আছে। তবে এগুলো তদন্তের স্বার্থে আমরা প্রকাশ করবো না।

গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় বিএসএমএমইউ কতৃপক্ষের করা তদন্ত কমিটি এই ডাক্তারের সংশ্লিষ্টতা পায়নি জানালে তিনি বলেন, তারা কেন পায়নি সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে তিনি জড়িত থাকতে পারেন তাই ‍উনাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

প্রলয় গ্যাং সদস্যদের হাতে সেদিন এই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন জানিয়ে তার আহতের ছবি এই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দেখাতে চাইলে তিনি বলেন, এই ফ্যাসিস্টের ছবি আমাকে দেখাবেন না। এরকোন ছবিই আমি দেখতে চাই না।

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

বিশ্ববিদ্যালয় এর সর্বশেষ খবর

বিশ্ববিদ্যালয় - এর সব খবর



রে