ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

যেভাবে শহীদ হয়েছিলেন ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের আলোচিত সেই রাজু

২০২৫ মার্চ ১৩ ১৪:২৬:১০
যেভাবে শহীদ হয়েছিলেন ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের আলোচিত সেই রাজু

ডুয়া ডেস্ক: আন্দোলন মানেই যেন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়ানো। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে অবস্থিত। পথে চলা সাধারণ মানুষের পাশাপাশিবিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও এই ভাস্কর্যের প্রকৃত ইতিহাস জানে না। অনেকেই মনে করেন এটি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক কিন্তু এর আসল ইতিহাস প্রজন্মের বেশিরভাগ মানুষ জানে না বা জানতেও চায় না। আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে এই উদাসীনতা আসলে আমাদের এক দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর একত্রিত জোট গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলের সময় সন্ত্রাসীরা গুলি চালায় আর এর শিকার হন মিছিলের নেতৃত্বদানে থাকা বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু। তার এই শহীদ হওয়ার ঘটনা থেকেই নির্মিত হয় এই ভাস্কর্যটি, যা রাজু ও সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের অন্যান্য শহীদের স্মৃতিরক্ষায় প্রতিষ্ঠিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রাজু। পুরো নাম মঈন হোসেন রাজু। ছাত্র ইউনিয়নের একজন নিবেদিত নেতা ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্বপ্ন নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন: একটি সুশাসিত সমাজ গড়ার স্বপ্ন, যেখানে সাম্যবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। রাজু ছিল সাহসী, জেদি, এবং আত্মবিশ্বাসী। তার মধ্যমণি চরিত্রের কারণে সে সবার কাছে ছিল প্রিয়।

রাজুর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন ছিল অনুকরণীয়। ক্লাস, পড়াশোনা, সংগঠন—সব কিছুতেই ছিল তার কর্তব্যনিষ্ঠা। তবে তার সব সময়ের মনোযোগ ছিল ক্যাম্পাস, বন্ধু-বান্ধব এবং আন্দোলনে। যদিও তার পরিবার ছিল রাজধানীর শ্যামলীতে, সে তার সময়ের বড় অংশই কাটাতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ হলের ১২২ নম্বর রুমে।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ, রমজান মাসের এক শুক্রবার রাজু তার সহযোদ্ধাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। এ সময় হঠাৎই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা একে অপরের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। টিএসসি এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কোনও কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। পুলিশকে এর প্রতিবাদে রাজু প্রথম সোচ্চার হয়ে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারদের অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান। তার প্রতিবাদ ছিল সাহসী কিন্তু পুলিশ তখন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছিল।

এই পরিস্থিতিতে রাজু ও তার সহযোদ্ধারা মিছিল বের করেন। মিছিলে শামিল হয় বাম ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাও। তাদের শ্লোগান ‘অস্ত্রশিক্ষা একসাথে চলবে না’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ এক হও’। হঠাৎ হাকিম চত্বরের কাছ থেকে একটি ঝাঁক বুলেট মিছিলে আঘাত হানে আর একটি গুলি রাজুর কপালে লাগে।

রাজু তার শ্লোগান মুখে নিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর তার বন্ধুরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানে তার রক্তের অভাবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রাজু চলে যান কিন্তু তার পরিবার ও বন্ধুদের জন্য এই শোক ছিল অদ্বিতীয়।

রাজুর কাঁধে থাকা ব্যাগে ছিল তার জীবনের কবিতা ও আঁকার ব্রাশ। সেই রক্তমাখা শার্ট ও ব্যাগ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। মৃত্যুর আগে রাজু মাকে বলেছিলেন, “দেখো, একদিন আমার পরিচয়ে তুমি পরিচিত হবে।” আজ তার সেই কথা সত্যি হয়ে উঠেছে।

১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. আজাদ চৌধুরী রাজু ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন। এই ভাস্কর্যের নকশাকার শ্যামল চৌধুরী, যিনি ঢাকা চারুকলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম ছিলেন তা তৈরি করেছেন।

ভাস্কর্যটি ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রদর্শন করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছায়; সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

এই ভাস্কর্যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যারা রাজুর আন্দোলনের সহযোদ্ধা ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।

আজও এই ভাস্কর্য রাজুর চেতনা ও সংগ্রামের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা বর্তমান প্রজন্মকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিক্ষা দেয়।

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

বিশ্ববিদ্যালয় এর সর্বশেষ খবর

বিশ্ববিদ্যালয় - এর সব খবর



রে