ঢাকা, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

প্রাইজবন্ডের আড়ালে জালিয়াতি!

২০২৫ মার্চ ০৪ ১২:৫৬:৪৯
প্রাইজবন্ডের আড়ালে জালিয়াতি!

ডুয়া নিউজ: বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড, সঞ্চয়ের লক্ষে বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত এক প্রকার কাগুজে মুদ্রা পদ্ধতি যা দেশের বাজারে সর্বপ্রথম চালু হয় ১৯৭৪ সালে। সরকারের পক্ষে প্রাইজবন্ডের যাবতীয় কাজ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোথাও প্রাইজবন্ডের লেনদেন সাধারণত বেআইনি।

ভাগ্য পরিবর্তনে বিশ্বাসীরা সাধারণত ১০০ টাকা মূল্যমানের এই প্রাইজবন্ড কিনে থাকেন। তবে যারা এটি কিনে থাকেন তাদের মধ্যে কেবল একটা অংশেরই শুধু ভাগ্য বদল হয় বলে একটি সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে রাজধানীর এক পরিবারের চার সদস্য টানা তিনটি লটারিতে ১০টি পুরস্কার জিতেছেন। গত বছরের ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত ১১৬তম ড্র বা লটারিতে তৃতীয় পুরস্কার পাওয়া প্রাইজবন্ডের নাম্বার গঝ-০১৬৮০১৮।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ১১৭তম ড্রয়ে আটটি পুরস্কারেরও দাবিদার ওই একই পরিবার যার পাঁচটি পুরস্কারের মধ্যে একটি দ্বিতীয় (৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা), একটি তৃতীয় (১ লাখ টাকা) এবং আর তিনটি চতুর্থ পুরস্কার (৫০ হাজার টাকা)। অথচ লাখ লাখ টাকার প্রাইজবন্ড কিনে কখনো একটিও পুরস্কার পাননি এমন লোক হাজার হাজার। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা দুই মাস অনুসন্ধান শেষে নিশ্চিত হওয়া যায় লটারি বেচাকেনায় ভয়ঙ্কর জালিয়াতি হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যারা অবৈধ টাকা উপার্জন করেন, তাদের একটি অংশ লটারিতে জেতা প্রাইজবন্ড কিনছেন। নিজের নামে অথবা স্ত্রী-সন্তানের নামে লটারিতে পাওয়া অর্থ হিসেবে আয়কর ফাইলে দেখাচ্ছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একটি বিজয়ী প্রাইজবন্ড কয়েকদফায় হাতবদল হচ্ছে।

অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে দেখা যায়, গত আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তত ৩২ জন সংসদ সদস্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কমিশনে যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তারা সবাই প্রাইজবন্ড থেকে আয় দেখিয়েছেন।

জানা যায়, প্রাইজবন্ড মূলত জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের একটি আর্থিক পণ্য। তবে এর সবকিছু দেখভাল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বছরে চারবার ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসের সম্মেলন কক্ষে ঘটা করে এর ড্র অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাইজবন্ডে প্রতি সিরিজের জন্য ৪৬টি পুরস্কার রয়েছে, যার মূল্যমান ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রথম পুরস্কার একটি ৬ লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার একটি ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা, তৃতীয় পুরস্কার দুটি ১ লাখ টাকা করে, চতুর্থ পুরস্কার দুটি ৫০ হাজার টাকা করে এবং পঞ্চম পুরস্কার ৪০টি ১০ হাজার টাকা করে।

অর্থাৎ বছরে প্রদত্ত পুরস্কারের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। প্রতিবছরের ৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই এবং ৩১ অক্টোবর প্রাইজবন্ডের ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে প্রতিবছর জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর মোট ১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৮২টি পুরস্কার ঘোষণা করে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ওঠে প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের টাকা পায় কয়জন?

প্রাইজবন্ড বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে প্রক্রিয়ায় ড্র অনুষ্ঠিত হয়, একজন বারবার অনেক পুরস্কার পাওয়া অস্বাভাবিক। এভাবে পুরস্কার পাওয়ার জন্য অন্তত কয়েক কোটি টাকার প্রাইজবন্ড কিনে রাখতে হবে। যদিও মাঝেমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, একই ব্যক্তির নামে অনেক প্রাইজবন্ডের দাবি জমা হচ্ছে। তবে প্রাইজবন্ডের পুরস্কার দেওয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ বিষয়ে কিছু বলা না থাকায় তারা পুরস্কারের অর্থ দিয়ে দেন।

তারা জানান, এমন অনেক ঘটনা তারা শুনেছেন- প্রাইজবন্ডে কেউ হয়তো ৬ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। কর কাটার পর তিনি পাবেন ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ জন্য তাকে প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। অথচ ওই চক্র তার কাছ থেকে পাঁচ লাখ বা আরও বেশি টাকায় কিনে নিচ্ছে। এরপর আবার অন্যদের কাছে তারা বিক্রি করছে। যিনি কিনছেন তিনি নিজের আয়কর নথিতে দেখান যে, প্রাইজবন্ডের পুরস্কার থেকে ওই আয় এসেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় আরেকজনের পুরস্কার কেউ কিনে নিজের নামে চালিয়ে দিলে ধরার উপায় থাকে না।

তবে সময়ের পরিবর্তনে এখন যদি প্রাইজবন্ড বিক্রি ও পুরস্কার প্রদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা ভেবে দেখবে। এ ছাড়া এসব জালিয়াতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত থাকলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিবেদনে এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার পরিচয় মাইনুল ইসলাম, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার নিচতলায় ছেড়া-ফাঁটা নোট বিনিময়ের ব্যবসা করেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে যারা নতুন নোট বিক্রি করেন তাদের কাছে সরবরাহ করেন তিনি। মোটাদাগে এই পরিচয়ে সবার কাছেই পরিচিত মাইনুল। কিন্তু এর বাইরে প্রাইজবন্ড বিক্রির হাতবদলের নেটওয়ার্ক রয়েছে তার। যেসব প্রাইজবন্ড ড্রতে বিজয়ী হয় সেইসব প্রাইজবন্ড নগদ টাকায় কিনে নেয় মাইনুল চক্র। এরপর কয়েক দফায় হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় ভিআইপিদের কাছে।

সেই প্রাইজবন্ড আবার ফেরত আসে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কোনো উত্তর না দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায় মাইনুল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের ভেতরে প্রকাশ্যে এই বেচাকেনা চলে বলে দাবি করেছে প্রতিবেদনটি।

২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের মনোনীত ৩২ জন প্রার্থী যারা অন্যের পাওয়া প্রাইজবন্ড কিনে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করেছেন। মোটাদাগে প্রাইজবন্ড বাবদ বিপুল পরিমাণ আয় দেখিয়েছেন তাদের নির্বাচনি হলফনামায়।

এর মধ্যে গত জাতীয় নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-২ (লৌহজং-টঙ্গীবাড়ী) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। ২০২৩ সালের হলফনামায় তিনি ৩৬ লাখ ৭০ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড বাবদ আয় উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু ২০০৮ সালের হলফনামায় প্রাইজবন্ড বাবদ তথ্য ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

হলফনামা পর্যালোচনা করে আরও যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের গোলাম দস্তগীর গাজী, পঞ্চগড়-১ আসনের মো. মজাহারুল হক প্রধান, নওগাঁ-১ আসনের সাধন সাধন চন্দ্র মজুমদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের আনিসুল হক, রাজশাহী-১ আসনের ওমর ফারুক চৌধুরী, রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হক, রাজশাহী-৬ আসনের শাহরিয়ার আলম, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সামশুল হক চৌধুরী, কুমিল্লা-৬ আসনের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আবদুল মমিন মণ্ডল, কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন, গাইবান্ধা-৫ আসনের মাহমুদ হাসান, ঢাকা-৬ আসনের মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, কুমিল্লা-৩ আসনের ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের মো. জাকির হোসেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের মাহমুদ হাসান, যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরী, ঝিনাইদহ-৪ আসনের আনোয়ারুল আজীম আনার, রাজবাড়ী-২ আসনের জিল্লুল হাকিম, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খান, মেহেরপুর-২ আসনের মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, কুমিল্লা-১০ আসনের আওয়ামী আ হ ম মুস্তফা কামাল, মৌলভীবাজার-৪ আসনের মো. আব্দুস শহীদ, হবিগঞ্জ-৩ আসনের মো. আবু জাহির ও বরিশাল-১ আসনের আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অন্যের পাওয়া প্রাইজবন্ড কিনে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের বিষয়টি এখনো কেন বন্ধ হয়নি কিংবা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এটি আশ্চর্যের বিষয়।

এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়ে ২০২২ সালেও চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। জানতে চাইলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর-এর মহাপরিচালক জাকিয়া খানম বলেন, এসব বিষয়ে আমার জানা নেই। কোনো ধরনের অভিযোগও কেউ করেনি। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে