ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমে ভাষার প্রয়োগ

২০২৫ জানুয়ারি ০৮ ১৪:১৪:৫৮
সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমে ভাষার প্রয়োগ

ভাষা মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। পারস্পরিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে আদিকাল থেকেই ভাষা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে প্রধানত যোগাযোগের মাধ্যম হলেও এর রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যবহার। আম জনতার মনের ভাব প্রকাশক, দোভাষীর রুটি-রুজির মাধ্যম আবার শাসকের কাছে শোষণের হাতিয়ার। বহুকাল আগে থেকেই ভাষার রাজনীতি পৃথিবীতে তার পূর্ণ দাপটের সাথে টিকে আছে। বিশেষভাবে ভারতবর্ষে তার দাপট একটু বেশিই বটে। এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতিগত বৈচিত্র্য যেমন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বেশি তেমনি ভাষা গত বৈচিত্র্যও অনেক।

সম্পদ আর প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ স্বর্গীয় আবাসভূমি ভারত ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকদের প্রধান লক্ষ্য। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-মুসলিম চার ধর্মেরই শাসন চলেছে এই দেশে। প্রথমেই আসবে হিন্দু সাম্রাজ্যগুলোর কথা। সে যুগে সংস্কৃত ছিল এলিট শ্রেণির ভাষা। ধর্ম গ্রন্থগুলোও শুধু তারাই পড়তে পারতো। নিম্নবর্ণের কেউ পড়ার, দেখার কিংবা শোনার চেষ্টা করলেও তার জন্য অবধারিত ছিল ভয়ঙ্কর সাজা। কোন ম্লেচ্ছ ভাষা বিশেষত বাংলায় ধর্ম গ্রন্থের অনুবাদ করা ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। করলে শাস্তি স্বরূপ পরপারে তার জন্য নির্ধারিত ছিল রৌরব নামক নরক। এভাবেই নিন্মবর্ণের লোকদেরকে সংস্কৃত ব্যবহার থেকে দূরে সরিয়ে দাস কিংবা দলিত বানিয়ে রাখা হতো। বহু শতাব্দী পর সুলতানি আমলের মুসলিম শাসকগণ রামায়ন, মহাভারতের মতো গ্রন্থগুলো বাংলা অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে অবহেলিত বাংলাকে তার গৌরব ফিরিয়ে দেন। মসলিম শাসনামলেও ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল তুর্কি, ফার্সী, আরবির মতো বিদেশি ভাষাগুলো। আফগান, তুর্কি, ইরানি কিংবা আরব যে শাসকই ভারতের শাসনভার নিতেন তাঁর নিজস্ব ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা বানিয়ে নিতেন এবং যারা এই ভাষায় দক্ষ তাদেরকেই রাজকার্যে আসীন করতেন। এতে করে যেমন তাঁরা বিশ্বস্ত কিছু আমির ওমারা পেতেন তেমনি ঐ ভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সমাজে সাংস্কৃতিক আধিপত্যও বিস্তার করতে পারতেন।

ব্রিটিশরা যখন ভারতের শাসনভার দখল করলো তখন তাঁরাও ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা বানিয়ে দেয়। ইংরেজি ভাষা নিয়ে তখন লোকজন দুভাগে বিভক্ত হয়। একদল ইংরেজি শেখাকে জরুরি মনে করে। ফলস্বরূপ তারা রাজকার্যের অংশীদারিত্ব পায় এবং উত্তরোত্তর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যায়। আরেকটি দল ইংরেজিকে বিধর্মীর ভাষা ঘোষণা দিয়ে তা শেখাকেও হারাম ঘোষনা দেয়। ফলস্বরূপ ২০০ বছর ধরে তারা নিষ্পেষণের শিকার হয়। এভাবে একটি দলকে অধিক সুবিধা আর আরেকটি দলকে অধিকার বঞ্চিত করে ব্রিটিশরা তাদের শোষণের পথকে সুগম করে।

উপমহাদেশে হিন্দি-উর্দু বিতর্ক দীর্ঘদিনের। একসময় হিন্দুস্তানি তথা উর্দু ভাষাই ছিল মূলভাষা। উর্দু লেখা হতো ফার্সি হরফে । কিন্তু ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায় মনে করতেন এটা মুসলমানদের লিপি। তাদেরও নিজস্ব ভাষা ও লিপি থাকা দরকার। তাই ১৮৫০ সালে হিন্দুস্তানি ভাষাকে দেবনাগরি লিপিতে লেখা শুরু করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। পরবর্তীতে ভারত ১৯৫০ সালে হিন্দিকে হিন্দুস্তানি ভাষার স্থলে বিশেষ মর্যাদা দেয় এবং রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে।

আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্মের প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়েছিল ভাষার মাধ্যমে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম এবং শোষণের হাতিয়ার হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে পাকিস্তানি শাসকেরা। অধিকার সচেতন বাঙ্গালি প্রতিবাদ জানায়। সভা-সমাবেশ হয়। আন্দোলন-বিক্ষোভ হয়। সালাম-রফিকরা প্রাণ দেয় আর আমরা আমাদের মায়ের ভাষাকে আবারও মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন দেখতে পাই। পাকিস্তানি শাসনের ভীত ৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারীতেই নড়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সেটা তরান্বিত হয়ে ১৯৭১ সালে তার কবর রচিত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাষার রাজনীতি নতুন মোড়কে উন্মোচিত হয়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠে বাংলা ভাষা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে শৈশব থেকেই একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দগুলোকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। 'আত্মীকৃত' নামে নতুন একটি পরিভাষার জন্ম দেওয়া হয় যেখানে কিছু শব্দকে নিজের করে নেওয়া হয় আবার কিছু শব্দকে বহিরাগত হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

এখানে ইংরেজি ভাষা থেকে উৎপত্তি হওয়া সত্ত্বেও 'খ্রিষ্টান' শব্দে 'ষ' ব্যবহার করা হয় আত্মীকৃত হওয়ার যুক্তি দিয়ে। কিন্তু 'ঈদ', 'ঈমান' শব্দগুলো সাথে মূল উচ্চারণের সামঞ্জস্য রাখার জন্য বহুকাল ধরে 'ঈ' দিয়ে লেখা হলেও বিদেশি শব্দ হিসেবে এখন 'ই' দিয়ে লেখা হয়। 'কাগজ', 'জাদু', 'জাহাজ', 'জেব্রা' ইত্যাদি শব্দ বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষার ধ্বনি পদ্ধতি অনুযায়ী লেখা হচ্ছে, কিন্তু ‘আযান’, ‘ওযু’ ‘নামায’, ‘রমযানের' মতো শব্দগুলো বিশেষ নিয়মে আলাদা ভাবে 'য' দিয়ে লেখা হচ্ছে।

শৈশব থেকেই যখন একজন শিশুর মস্তিষ্কে এই ধরণের ভাষাগত বিভেদ ঢুকানো হয় তখন সে অবচেতন মনে ধরে নেয় যে এই শব্দগুলো বাংলা এবং ঐগুলো বিদেশি। সুতরাং ঐ শব্দের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোও বিদেশি তাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের সংস্কৃতিও ভিন্ন। অথচ হাজার বছর ধরে স্বর্গীয় এই আবাসভূমিতে বাংলা মায়ের আলো-বাতাস নিয়ে, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ সমান ভাবে বেঁচেছে, অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছে। তাই নতুন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমের হাতিয়ার হিসেবে ভাষার ব্যবহার বন্ধ হোক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে এই বাংলা ভূমি পৃথিবীর বুকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হোক এটাই কামনা করি।

শামসুল আলম শিহাব

প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিভাগ, সমাজবিজ্ঞান

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

মতামত এর সর্বশেষ খবর

মতামত - এর সব খবর



রে