ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

দুবাইয়ে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

২০২৫ জানুয়ারি ০৭ ২০:৩২:৪১
দুবাইয়ে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

ডুয়া নিউজ: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের কাছে দুবাই একটি পছন্দের স্থান। দেশটিতে খুব সহজে গোল্ডেন ভিসা পাওয়া, সম্পত্তি ক্রয় ও বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীরা দেশটিকে দ্বিতীয় হোম হিসেবে ব্যবহার করছেন। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশি ধনীদের কাছে দুবাই ভীষণ প্রিয়। অনেকে এটিকে সেকেন্ড হোম হিসেবে আপন করে নিয়েছেন।

দুবাইয়ের দ্রুত সম্প্রসারিত আবাসন খাত বাংলাদেশিদের জন্য সম্পদ গচ্ছিত রাখার আকর্ষণীয় জায়গা। এর বড় কারণ হলো—সুউচ্চ ভবন ও পর্যটনের জন্য খ্যাত দুবাইয়ে নগদ অর্থ দিয়ে সম্পত্তি কেনা যায়। এমনকি শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও নগদ অর্থে সম্পত্তি বিক্রি করে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বারবারই দুবাইকে হুন্ডি লেনদেনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। বিশাল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক ও বাংলাদেশিদের সেখানে অবস্থান করা এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া, দুবাইয়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার ডলার বা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি অর্থ দেশটির সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করলে ‘গোল্ডেন ভিসা’ পাওয়া যায়।

দেশটিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও ধনীদের অঢেল সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্যাক্স অবজারভেটরির ২০২১ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন অফশোর সম্পত্তির মূল্য ২৬ কোটি ডলার, যা প্রায় ৩,১১৪ কোটি টাকার সমান। বিনিয়োগের পরিমাণের দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পর বাংলাদেশি ধনীদের পছন্দের গন্তব্য হিসেবে দুবাই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ দুবাই ভূমি বিভাগের ২০২০ ও ২০২২ সালের রেকর্ড ও কিছু ইউটিলিটি কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে একটি ডেটাসেট তৈরি করে যেটি ২০২৪ সালের শুরুর দিকে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের ‘দুবাই আনলকড’ শীর্ষক বৈশ্বিক তদন্তে ব্যবহার করা হয়। এই ডেটাবেস অনুযায়ী ৪৬১ বাংলাদেশির নামে দুবাইয়ে ৯২৯টি সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে। এসব সম্পত্তির মধ্যে ২৫৯টি রাজনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের নামে নিবন্ধিত।

এই ৯২৯টি সম্পত্তির দাম প্রাক্কলন করে দেখা গেছে যে, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন সম্পত্তির মোট দাম ৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

দুবাই ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি ১৯ জন ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ৮২টি সম্পত্তির কর, সেবা চার্জ ও অন্যান্য নথি সংগ্রহের তথ্য পাওয়া গেছে। এই ১৯ জনের মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবাল, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জিসান মির্জা, ব্যবসায়ী সায়েম সোবহান আনভীর এবং মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম সহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, তবে এসব সম্পত্তি বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কেনা হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এই সম্পত্তিগুলোর মোট মূল্য প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার বা ৩৫০ কোটি টাকা বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিছু সম্পত্তি গোল্ডেন ভিসা বা বিদেশী নাগরিকত্বের মাধ্যমে কেনা হয়েছে, যেমন সায়েম সোবহান আনভীর এবং তার পরিবারের সদস্যরা স্লোভাকিয়ার নাগরিকত্ব এবং সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। ওবায়দুল করিমও দুবাইয়ে গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের মাধ্যমে সম্পত্তি কিনেছেন।

দুবাইয়ের বিভিন্ন উচ্চমূল্যের এলাকা যেমন বুর্জ খলিফা এবং পাম জুমেইরায় তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তি রয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের আর্থিক অনিয়মের মামলায় জড়িত।

তবে, সম্পত্তি কেনার অর্থের উৎস এবং তা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে কিনা, সে সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস অনুযায়ী, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারে দুইজন বাংলাদেশি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এর মধ্যে সায়েম সোবহান আনভীরের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, কারণ শুধুমাত্র তার নথি দুবাই ভূমি বিভাগ থেকে পাওয়া গেছে। পাম জুমেইরায় সম্পত্তির মালিক ২০ বাংলাদেশির মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বুর্জ খলিফা এলাকায় বাংলাদেশি মালিকানাধীন কমপক্ষে ৬১টি সম্পত্তি রয়েছে, যার মধ্যে ২১টির নিবন্ধন এমন চারজন ব্যক্তির নামে, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে আর্থিক অনিয়মের মামলা চলছে।

এছাড়াও, অনেক বাংলাদেশি নাগরিক গোল্ডেন ভিসা ব্যবহারের মাধ্যমে লেয়ারিং পদ্ধতিতে এসব সম্পত্তি কিনেছেন। উদাহরণস্বরূপ, সায়েম সোবহান আনভীরের ফ্ল্যাটটি তার যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি "ওয়ার্ল্ডএরা করপোরেশন এফজেডই" এর নামে কেনা হয়েছে। কোম্পানির নথিতে তাকে স্লোভাকিয়ার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু স্লোভাকিয়া গোল্ডেন পাসপোর্ট প্রদান করে, যার জন্য অন্তত ১০০ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন।

সায়েম সোবহানের ভাই সাফওয়ান সোবহান দুবাইয়ের কর্নিশ ১ স্ট্রিটে এমিরেটস হিল থার্ড এলাকায় বাস করেন। তবে দুবাই ভূমি বিভাগ থেকে এই সম্পত্তির মালিকানা তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাজ্য কোম্পানি রেজিস্ট্রির তথ্যে তাকে সাইপ্রাসের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি সাইপ্রাসে ২০১৪ সালে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

অন্যদিকে, ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিমও একইভাবে দুবাইয়ে সম্পত্তি কিনেছেন। তবে তার নামে নিবন্ধিত সম্পত্তিগুলোর কোনোটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেনা হয়নি।

দুবাইয়ের একটি হোটেলের রেজিস্ট্রেশন নথিতে ওবায়দুল করিমকে আলবেনিয়ার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হোটেলের মালিকও তিনি। আলবেনিয়ার করপোরেট রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর আলবেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত তার মালিকানাধীন কোম্পানি "অ্যাগ্রি প্রোডাক্টস ইউরোপ" রয়েছে। আলবেনিয়া ২০২৩ সাল পর্যন্ত গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রদান করেছে।

বাহরাইনের করপোরেট রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডে ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়ন ফার্মার, যেখানে ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। যদিও তার ছেলেকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওবায়দুল করিমকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কোম্পানিটি ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

দুবাইয়ের কোম্পানি রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওবায়দুল করিমের মেয়ে জারিন করিম সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক "জেশা জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি" এর মালিক। তাকে ২০২৩ পর্যন্ত ডোমিনিকান নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ডোমিনিকান নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য সেখানে ২ লাখ ডলার রিয়েল এস্টেট খাতে অথবা অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ তহবিলে বিনিয়োগ করতে হয়। এছাড়াও, ২০২২ সালে ডোমিনিকান পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছিল, যা ঢাকা বিমানবন্দর সূত্র নিশ্চিত করেছে।

২০২৪ সালে জারিন করিম ডোমিনিকার সম্মানসূচক কনসাল হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ পান এবং তিনি এখনও এই পদে আছেন।

দুবাইয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের অন্তত ৩৭টি সম্পত্তি রয়েছে, যার মোট মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এই সংখ্যা দুবাইয়ে কোনো বাংলাদেশির নামে নিবন্ধিত সর্বোচ্চ সম্পত্তির সংখ্যা। সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ নিজেকে আমেরিকান সামোয়ার নাগরিক দেখিয়ে অন্তত ১০টি সম্পত্তি কিনেছেন। এছাড়া, তার নামে আরও ১৬টি সম্পত্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতবদল হয়েছে, যার মধ্যে ২০২৪ সালে ৪টি, ২০২৩ সালে ৯টি, ২০২২ সালে ১টি এবং ২০২১ সালে ২টি সম্পত্তি বিক্রি হয়েছে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস অনুযায়ী, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে আরও অন্তত ২৪টি সম্পত্তি রয়েছে, তবে পাসপোর্ট নম্বর বা জন্ম তারিখের মতো অতিরিক্ত তথ্য না থাকায় এটি নিশ্চিত নয় যে, এগুলো তারই মালিকানায়। তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির নামে পাম জুমেইরার গোল্ডেন মাইল ৪-এ দুটি কক্ষবিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি টাকা।

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে