ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অমর দলিল

২০২৫ জানুয়ারি ০৭ ১৯:৫২:০০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অমর দলিল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি জাতীয় চেতনা, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এর প্রতিটি অধ্যায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূতিকাগার হয়ে ওঠে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম জাগরণ। এ আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারদের মতো ভাষা শহীদদের অনেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবির সমর্থনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়ায়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মূল কেন্দ্রও ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে আসাদসহ বহু ছাত্র জীবন উৎসর্গ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এবং মধুর ক্যান্টিন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। ২ মার্চ ঢাবির কলাভবন প্রাঙ্গণে আ স ম আবদুর রব বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী সূচনা।

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে ঢাকার ওপর হামলা চালায়। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাতের অন্ধকারে জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ হল, এবং রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় চালানো হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা এবং মুনীর চৌধুরীর মতো অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা হয়।

এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা সংগঠক, যোদ্ধা এবং কূটনৈতিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ঢাবি শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা গেরিলা কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও তথ্য সরবরাহ করেন। বিশেষত ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং ৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬শে মার্চের মেজর জিয়াউর রহমান সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণার পর ঢাবির ছাত্ররা দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিকল্পনা কেন্দ্র।

ডিসেম্বর ১৯৭১-এর প্রথম দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আল-বদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য অভিযান চালায়। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. রাশিদুল হাসানসহ অনেক শিক্ষাবিদকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশ্য ছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশের মেধাবী সমাজকে ধ্বংস করা। তবে এই ত্যাগ জাতিকে একত্রিত করেছে এবং স্বাধীনতার জন্য অদম্য শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ। এর মধ্যে অন্যতম হলো অপরাজেয় বাংলা, যা বাঙালির চিরন্তন সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদের প্রতীক। এছাড়া রাজু ভাস্কর্য, স্মৃতি চিরন্তন, এবং সপ্তশহীদ স্মৃতিস্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণত রাষ্ট্রের সৃষ্ট হলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এটি কেবল একাডেমিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার চেতনার উৎস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছে, তা কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন নয়; এটি জাতীয় চেতনা ও সংগ্রামের প্রতীক। শেখ মুজিবুর রহমান , যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতার যে সংগ্রাম সফল হয়েছে, তার মূলে ছিল ঢাবির অবদান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এটি প্রমাণ করেছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্রগঠনের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। তাই ঢাবির গৌরবময় ইতিহাস কেবল স্মরণ করাই নয়, এটি আরও সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরসূরীরা আগামীতেও একই সাহসিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে আসবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মচারীদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি স্বাধীন, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ঢাবির উত্তরসূরীরা ভবিষ্যতেও একই নিষ্ঠা ও ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত থাকবে।

এমাদ উদ্দিন

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ডিপার্টমেন্ট, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

ডুয়ার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

মতামত এর সর্বশেষ খবর

মতামত - এর সব খবর



রে